‘নকশী কাঁথা’ কারুশিল্পের এক অনন্য সৃষ্টি

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নকশী কাঁথা শব্দটির সাথে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য উতপ্রেতভাবে জড়িত। আবহমানকাল ধরে এ দেশের মানুষ নকশী কাঁথা ব্যবহার করে আসছে।কাঁথার আভিধানিক অর্থ হলো – জীর্ণ বস্ত্রে তৈরি শোয়ার সময় গায়ে দেয়ার মোটা শীত বস্ত্র বিশেষ। আর নকশী কাঁথা হলো-গ্রাম বাংলার বধূ-কন্যারা মনের মাধুরী মেশানো রং দিয়ে সূঁচ আর সুতোর সাহায্যে সুনিপুণ হাতে নান্দনিক রূপ-রস ও বর্ণ-বৈচিত্র্যে ভরা তুলনামূলক পাতলা কাঁথা। এটি গ্রামীণ মহিলাদের শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হলেও নকশী কাঁথা শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের আর্থ-সামাজিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। রাজ-বাদশাদের জীবন কাহিনী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, পৌরাণিক কিচ্ছা কথা, নর-নারীর প্রেম-বিরসহ অনেককিছু মিশে থাকে এ শিল্পের প্রতিটি বুননে।

নকশী কাঁথা পল্লীর নারীদের শিল্প মনের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি। তারা বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের উপর সুঁচ আর সুতোর ফুটিয়ে তোলেন ফুল, লতাপাতা, হাতি, ঘোড়া, পাখি, গাছ, লাঙ্গল, নৌকা, চাঁদ-তারা ইত্যাদি। বিভিন্ন অঞ্চলে ফোড়, পাইড় ও নকশা অনুযায়ী নকশী কাঁথা ভিন্ন ভিন্ন নামেও পরিচিত। এগুলো হচ্ছে-বরকা ফোঁড়, তেজবি ফোঁড়, বাঁশপাতা ফোঁড়, কইতা ফোঁড় ও বিছা ফোঁড় ইত্যাদি পাড়ের নামে তোলো পাইড়, তাস পাইড়, নয়নলতা, নারিকেল পাতা ও নৌকা বিলাসসহ আরো অনেক নামের নকশী কাঁথা রয়েছে। ব্যবহার অনুযায়ী এগুলোর নামও ছিল ভিন্নতা। যেমন-শীতের জন্য লেপকাঁথা, বালিশে ব্যবহারের জন্য বয়তন, বসার জন্য আসনকাঁথা, খাবারের জন্য ব্যবহৃত দস্তরখান, নামাজের জন্য জায়নামাজ কাঁথা ইত্যাদি।গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বিয়েতে এবং আত্মীয়-স্বজনকে কাঁথা উপহার দেয়ার প্রচলন ছিল একসময়।কালের বিবর্তনে নকশী কাঁথা এখন আর নিত্য ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়না। শৌখিনতা, ঐতিহ্য বিবেচনা, আর বৈদেশিক চাহিদা থাকায় নকশী কাঁথার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে নতুন করে।
বাংলাদেশের এমন কোন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কাঁথার ব্যবহার হয় না। নকশী কাঁথায় থাকে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি, সমাজ-সভ্যতা, প্রকৃতির অপর সৌন্দর্য, গৌরবগাঁথা ও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। একে নিয়ে লেখা হয়েছে গান, কবিতা, কাব্যসহ অনেক রচনা। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *