কল্লোল যুগ বলতে বাংলা সাহিত্যের একটি ক্রান্তিলগ্নকে বোঝায়, যখন বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যে আধুনিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল।
কল্লোল যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা। যে সময়ে কল্লোলের আবির্ভাব, তখন বাংলা সাহিত্যের সর্বকোণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাবে প্রোজ্জ্বল। কল্লোল যুগের লেখকদের মূল লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্র বৃত্তের বাইরে এসে সাহিত্যের একটি মৃত্তিকাসংলগ্ন জগৎ সৃষ্টি করা।
‘কল্লোল’ নামে একটি সাময়িক পত্রের মাধ্যমে একদল তরুণ কবি-সাহিত্যিকের হাতে পাশ্চাত্য আধুনিকতার পত্তন হয়। অচিরেই অন্যান্য সাময়িক ও সাহিত্য পত্রেও এই আধুনিকতার পরশ লাগে।
কল্লোল এর অর্থ মহাতরঙ্গ বা কলরব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ১৯৩০-এর দশক কল্লোর যুগের সমার্থক। একদিকে ইংরেজদের শাসন-অত্যাচার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব, সারাবিশ্বে মার্কসবাদী চিন্তাধারার বিস্তার, অন্যদিকে নিজস্ব শিল্পসাহিত্যে থমকে থাকা ভাব। এইসময় দীনেশরঞ্জন দাস, মানবেন্দ্রনাথ বসু, গোকুলচন্দ্র নাগ ও সুনীতা সেন মিলে ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ নামে একটা ঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করতেন। এই ক্লাবটিতে সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও নাটক নিয়ে নিয়মিত আলোচনা ও চর্চা করা হতো।
১৯২২ সালে তাঁরা ‘ঝড়ের দোলা’ নামে একটি ছোটগল্প সংস্করণ বের করেন। ঝড়ের দোলা’র প্রেরণা নিয়েই ১৯২৩ সালে গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশচন্দ্র দাস ‘কল্লোল’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা ও একটি সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে তোলেন। যদিও মাত্র ৭ বছর(১৯২৩-১৯৩০) পর্যন্ত পত্রিকাটি টিকে ছিল, কিন্তু ধারা পরিবর্তনে পত্রিকাটির প্রভাব অনস্বীকার্য।
শুরুর দিকের রুপকার অচিন্তকুমার সেনগুপ্তের মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য- “ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই, সংকেত নেই। তিনিই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু ‘কল্লোল’ এসে আস্তে আস্তে সে ভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যে শুধু তাঁরই বহুকৃত লেখনির হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আরেক পরিচ্ছেদ।”
সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখার স্টাইলের বিরোধীতা করাটাই পত্রিকাটির অন্যতম লক্ষ্য বলে প্রাথমিক ধারণা করা গেলেও পরবর্তিতে ভাবহীন, সৌন্দর্যহীন ব্যাক্তিগত আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়।
কল্লোল পত্রিকাটি থেকে দ্রুত অনুপ্রাণিত হয় প্রগতি, উত্তরা, কালিকলম, পূর্বাশা ইত্যাদি পত্রপত্রিকা।
মূলত বাংলা কবিতায় গদ্যধারার প্রবর্তন শুরু হয় কল্লোল যুগেই। সমকালীন ইংরেজি ও বিদেশী সাহিত্যের অনুসরণে বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা পরিচিত হয় ন্যাচারালিজম, শারীরিক ভাবনা, জীবনসংগ্রাম, রাজনীতি, সমাজনীতি সহ নানা নতুন নতুন বিষয়ের সাথে। কার্ল মার্কস ও সিগমন ফ্রয়েডের চিন্তাধারার প্রভাবে সাহিত্যে এক নতুন রচনাশৈলী তৈরী হয়।
এ যুগের শক্তিমান কথা-সাহিত্যিকদের হলেন জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, মনোজ বসু, গোপাল হালদার, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, সুবোধ ঘোষ, গজেন্দ্রকুমার মিত্র সহ আরো অনেকে।
কবিতার ক্ষেত্রে যাদের নাম কল্লোল যুগের শ্রেষ্ঠ নায়ক বিবেচনায় প্রচারিত, তাঁরা হলেন- কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সঞ্জয় ভট্টাচর্য সহ অনেকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
রোমান্টিক আবেগের বদলে জীবনসংগ্রামের চিত্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক দুর্গতির প্রতি সহানুভূতি, নরনারীর সম্পর্ক বিচারে সংস্কারমুক্ত প্রকাশভঙ্গী, এবং সাহিত্যে পোয়েটিক জাস্টিসের বিরোধীতাই ছিল মূলত গরদভাঙ্গার কল্লোল যুগের বিশেষ অবদান।
উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ তথা নতুন ধারার সূচনা হয় কল্লোল যুগে। এই সময় থেকেই মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। এরপর একদল তরুণ কবি-সাহিত্যিকের হাত ধরে পাশ্চাত্য আধুনিকতার গোড়াপত্তন হয়। নতুন ধারা নিয়ে আসা কল্লোল যুগ বাংলা সাহিত্যকে বহুলাংশে সমৃদ্ধ করেছে।