বর্তমান সময়ের আলোচিত এক বিষয় ধর্ষণ, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সমাজের সকল স্তরের মানুষ। অভিভাবকরা প্রতিনিয়তই তাদের আদরের কন্যাশিশুদের নিয়ে ভীষণ আতঙ্কিত ও চিন্তিত। মেয়েরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরে-বাইরে, বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে, স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্রসহ সর্বক্ষেত্রে তারা আজ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
যেখানে একজন পুরুষ তার স্বাভাবিক জীবন-যাপনে কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয় না, সেখানে একজন নারীকে প্রতিনিয়ত বাধার সামনে পড়তে হচ্ছে। ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যধী, যার মুল কারন হচ্ছে আমাদের আজকের এই তালমাটাল সামাজব্যবস্থা। যেখানে আমরা একে-অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরছি, ক্রমান্বয়ে দুরে সরে যাচ্ছি আন্তরিক বন্ধন থেকে। ক্ষয় হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ।
কেউ কেউ বলে থাকে যে, ধর্ষণের জন্য মেয়েই দায়ী, কারন তার পোশাক-আশাক চলাফেরা ঠিক ছিলোনা। আবার কেউ কেউ বলে যে, তাহলে শিশুরা কেন ধর্ষিত হয়? যেখানে কিনা ওই শিশুটির শারিরীক গঠনই পরিপূর্নতা পায়নি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি! যে ছেলেটি এই ধর্ষণ-কার্যে লিপ্ত ছিল তার আসলে মূল সমস্যাটা কি ছিলো? কেন সে এমন ঘৃন্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে?
এর মূল কারন হচ্ছে পারিবারিক শিক্ষার অভাব। একটি মানুষের প্রথম শিক্ষা সে তার পরিবারের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। চরিত্র গঠনের শিক্ষাটাও আমরা পরিবারের কাছ থেকেই পেয়ে থাকি। বয়ঃসন্ধির কিছু সময় আগে থেকে ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতা ও যৌনবিষয়ক শিক্ষা দিতে হবে, যেন তারা যৌনতার অপব্যবহার না করে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের ভুলের ব্যাপারে অবহিত করা দরকার। যৌনতার ব্যাপারে মেয়েদের দোষ দেয়ার মানসিকতাও দূর করতে হবে।
নৈতিক শিক্ষা ছাড়া মানুষের মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় না। এ শিক্ষার শুরু পরিবার থেকে করার কথা, কিন্তু পারিবারিকভাবে এ শিক্ষা দিতে আমরা আজ ব্যর্থ। তাই সমাজে ঘটে চলছে নানা রকম অনৈতিকতা আর ধর্ষনের মত ঘৃন্যকাজ। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে পরিবার ও বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতনতামূলক অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলে সকলে মিলে আমরা একটি নৈতিক ও মানবিক দেশ ও সমাজ গড়তে পারব। পারিবারিক শিক্ষার উপরে আরো জোর দিতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে পুরো সামাজব্যবস্থাকে।
আমরা দিন দিন আধুনিক যুগে প্রবেশ করছি। হাতের কাছেই পাচ্ছি নিত্যনতুন অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস। কথায় কথায় ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছি মোবাইল,কম্পিউটার, ল্যাপটপ,প্যাড ইত্যাদি। যোগাযোগের মাধ্যমসমুহেও পরিবর্তন এসেছে ফেইসবুক, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, ইউটিউব ইত্যাদির ব্যবহারে। কিন্তু, আমারা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে, আধুনিকতার নামে আমরা আমাদের আগামীর ভবিষ্যত প্রজন্ম শিশু-সন্তাদেরকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছি ?
আজকাল হরহামেসাই দেখা যায় যে, অপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের হাতের মুঠোয় স্মার্ট ফোন ইর্ন্টারনেট। সারাক্ষণ চলে অবিরাম ফেইসবুকিং, বিভিন্ন খারাপ লিংকে লগিং, আর তার মাধ্যমেই কিশোর ছেলেরা ঝুঁকে পরে পর্ন-গ্রাফির দিকে। শুধু তাই নয়, মেয়েরাও অপরিচিত লোকের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে, অসহনশীল ছবি আদান প্রদানের মাধ্যমে অহরহ প্রতারিত হচ্ছে। এগুলোও পরবর্তী ধর্ষণকে প্রভাবিত করে।
আমরা আধুনিকতাকে বর্জন করতে বলবোনা, কিন্তু তা সঠিক বয়সে তাদের হাতের নাগালে দেয়া উচিত। পরিবারের বাবা-মায়ের উচিত কন্যাসন্তানের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করা। বাবা-মা যেন অবশ্যই জানে তার মেয়ের বন্ধু কারা, বা সে কাদের সাথে বাইরে ঘোরাফেরা করে। ঠিক একইভাবে মেয়েদের উচিত বাবা-মায়ের সাথে সমস্যা যতোই ক্ষুদ্র হোক না কেন, আলোচনা করে রাখা, তাদেরকে অবগত রাখা। নিজের বন্ধুর সাথে বাবা-মার পরিচয় করিয়ে দেয়া। কর্মজীবী নারীদের উচিত, তাঁর অফিস এনভায়রনমেন্ট সম্পর্কে বাবা, মা, স্বামীকে অবহিত করা।
আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা সবাই বলতে চাই, কিন্তু শুনতে চাই না। একটা ধর্ষণ ঘটার জন্য আমাদের সমাজের সবার এটা মনে রাখা উচিত, কখনোই একটা মেয়ে দোষী নয়। প্রথমেই আমরা যে ভুলটা করি, তা হল আমরা ভুলে যাই আমরা একজন ভিক্টিমের অ্যাক্সিডেন্টের জন্য তাকেই দোষারোপ করছি, যা মোটেই যৌক্তিক নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, একজন মেয়ে বা কন্যা সন্তান তার জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। সুতরাং তার বেঁচে থাকার জন্য আশেপাশের মানুষের একটু সহানুভূতির প্রয়োজন।
আবার কোথাও কোথাও দেখা যায়, গ্রাম্য সালিশ বসিয়ে ভিক্টিমকে সেই ধর্ষকের সাথেই বিয়ে দেয়া হয়, কিংবা টাকার মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়, আর না হলে ভিক্টিমকে এলাকা ছাড়া করা হয়। পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের এইসব সমাজব্যবস্থাতেও। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইন ২০০৩ সেকশন ৯ অনুসারে, ধর্ষণের শাস্তি বাস্তবায়নের দিকে জোর দিতে হবে। এখনি যদি আমরা এই ধর্ষণ নামক সমস্যার সমাধানে এগিয়ে না আসি, নিজ নিজ স্থান থেকে নিজেদের ভুমিকা পালন না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো একটা কলুষিত জাতি পাবে। আর আমরা পাবো একটি কলুষিত দেশ, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।
ডা: মো: মিঠুন
চিকিৎসক (হোমিওপ্যাথ)