রাজধানী ঢাকা একটি জনবহুল শহর, এর আয়তন ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা (প্রায়) ২ কোটি। এই বিশাল জনসংখ্যার মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় বিনোদনের জায়গা পর্যাপ্ত নয়। বিনোদনের যাও কিছু উম্মুক্ত স্থান(যেমন-পার্ক, মাঠ, লেক ইত্যাদি) রয়েছে, তা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় আছে। তাছাড়া বিনোদনের জায়গাগুলোতে যাতায়াত করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন, কারণ ঢাকা এখন যানজটের শহর হিসাবে পরিচিত। এইসব কারণে সব এলাকার মানুষ এতদূর যাতায়াত করে এই সব উম্মূক্ত স্থান ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, বিনোদনের প্রয়োজন কেন? আমরা খাবার খাই, কিন্তু খাবার হজম করার জন্য পেটের মধ্যে খালি জায়গার রাখি, যাতে পেটে বায়ু প্রবেশ করানো যায়। প্রতিটি প্রাণীর খাবার হজম করার জন্য বায়ুর প্রয়োজন। এই জন্য পেটের মধ্যে উম্মুক্ত স্থানের দরকার হয়, ঠিক তেমনি মানুষের মনের খাদ্য হজম করতে বিনোদনের প্রয়োজন হয়। জীবনকে উপভোগ করার জন্য ভালোভাবে বাঁচারও প্রয়োজন। সামাজিকতা এবং বিনোদনের চাহিদা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এটি একটি স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি আনন্দমুখর পরিবেশ সৃষ্টিতে বিনোদন অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। বিনোদন মানুষের মনকে প্রফুল্ল রাখে। মানুষের মনের একঘেয়ামি বা ক্লান্তি দূর করতে বিনোদন অপরিহার্য। পৃথিবীর প্রগতিশীল সকল রাষ্ট্রেই বিনোদনকে জাতীয় উন্নতির কর্মপ্রেরণার শক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শরীর ভাল থাকলে মন ভাল থাকে। মন ও শরীর ভাল রাখার জন্য বিনোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিনোদন মনের খাদ্য যোগায়। মনের ক্লান্তি দূর করতেও বিনোদনের প্রয়োজন। কবিগুরুর ভাষায় বলা যায়, বিশ্রাম কাজের অঙ্গ, একসাথে গাঁথা।
বিনোদন এবং সামাজিকীকরণের জন্য পর্যাপ্ত উম্মুক্ত স্থান না থাকার কারণে নগরীর মানুষ এখন নিঃসঙ্গ। নিজের পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। যখন একই সমাজে বসবাস করেও অন্য মানুষ বা প্রতিবেশীর সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ কম পায়, মানুষ তখন আত্মকেন্দ্রিক হয়, একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সামাজিকীকরণের অভাবে শহরে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরবাসীর জন্য সামাজিকীকরণের অন্যতম উপাদান হলো উম্মুক্ত স্থান এবং রাস্তা।
ঢাকা শহরে মানুষের অবসর যাপন এবং বিনোদনের জন্য তেমন কোন উম্মুক্ত স্থান চোখে পড়ে না। শিশুরা বাহিরে গিয়ে খেলার জায়গা পায় না। ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির কারণে রাস্তায় পার্কিং সুবিধা দিতে গিয়ে নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মত জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এখন ইচ্ছে করলেও বড় পার্ক বা খেলার মাঠ তৈরি করতে হয়তো পারবে না। পার্কিং এর কারণে যে স্থানটি দখল হয়ে থাকে সে স্থানটিতে সাময়িক সময়ের জন্য পার্কলেট (সামাজিকীকরণের ক্ষুদ্র জায়গা) তৈরির মাধ্যমে সামাজিকীকরণের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়।
এই সব বিবেচনায় বিনোদন এবং সামাজিকীকরণের জন্য শহরে পার্কলেটের গুরুত্ব অপরিহার্য। পার্কলেট বলতে একটি ছোট পার্ককে বুঝায়, যা ফুটপাথের বর্ধিত অংশ। পার্কলেট একটি নির্দিষ্ট ছোট জায়গার মধ্যে করা যায়। বিনোদনের কেন্দ্র হিসাবে একটি বা দুইটি গাড়ি পার্কিং এর জায়গায় এই পার্কলেট তৈরি করা যায়। পার্কলেট দুই ধরনের হতে পারে- কয়েক ঘন্টার জন্য অস্থায়ী পার্কলেট এবং স্থায়ী পার্কলেট। সরকার ইচ্ছে করলে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন এলাকাতে প্রতিদিন বা সপ্তাহে একদিন, স্থায়ী বা অস্থায়ী পার্কলেট তৈরি করতে পারে। যেখানে লুডু, দাবা, দড়ি লাফ ইত্যাদি খেলাসহ, বই পড়া, গল্প করা যায়। পথচারীসহ যেকোন মানুষ বসার জন্য পার্কলেট এ চার-পাঁচটা চেয়ারও থাকতে পারে।
পার্কলেট স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো মানুষ রাস্তায় চলাচলের সময় যেন এমন একটি জায়গা পায়, যেখানে অবসর যাপন করতে পারেন। শহরের বসবাসকৃত মানুষেরা তাদের বাসা-বাড়ি হতে সংক্ষিপ্ত হাঁটার মধ্যেই সামাজিকীকরণের সুযোগ পাবে। যেখানে শিশু ও তাদের অভিভাবক, বয়স্ক মানুষ, প্রতিবন্ধি/অপ্রতিবন্ধি মানুষসহ সব বয়সের মানুষ একসাথে সময় কাঁটাতে, অবসর যাপন বা খেলাধূলা করতে পারে। ফলে একে-অন্যের সাথে পরিচয়ের সুযোগ তৈরি হবে। এতে করে সামাজিকতা রক্ষা করা সহ একই এলাকার মানুষদের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হবে, সমাজে মানুষের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হবে, যা এখন ঢাকা শহরে সচরাচর দেখা যায় না বললেই চলে। পার্কলেটে বসার জায়গা ছাড়াও লাইব্রেরি, সাইকেল পার্কিং, গাছপালা, ফুলের টবসহ বিনোদনের বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকে।
শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, কিন্তু শহরের শিশুরা বিনোদনের অভাবে মানুষিক বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ পাচ্ছে না। বেশিরভাগ মা-বাবা চাকুরি করার কারণে শিশুরা সারাদিন ঘরে একরকম বন্দিই থাকে বলা চলে। শিশুদের পরিপূর্ণ মানুষিক বিকাশ না হলে, তারা কখনোই পরিবার বা রাষ্ট্রের জন্য সম্পদে পরিণত হতে পারবে না। একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য সম্পদ। সকল পার্থিব সম্পদের মধ্যে স্বাস্থ্য সর্বাপেক্ষা মূল্যবান, এটি ছাড়া বাকি সবই মূল্যহীন। শিশুদের খেলার কোন জায়গা না থাকায় তারা ঘরে বসে কম্পিউটার, গেমস ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্বাস্থ্যই সম্পদ, ভালো স্বাস্থ্য সুখের একটি নিশ্চয়তা। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যা কিছু করণীয় সেগুলো যত্ন সহকারে আমাদের সকলেরই করা উচিত।
প্রয়োজনীতাই উদ্ভবনের জনক, প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ বিচিত্র জিনিস সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ হয়। বিশ্ব সভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে রয়েছে প্রয়োজনীয়তা। প্রয়োজন অনুভব করে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে সান-ফ্রান্সিসকোতে শুরু হয় পার্কলেট আন্দোলন। বর্তমানে সান ফ্রান্সিসকোতে পঞ্চাশটির মতো স্থায়ী পার্কলেট রয়েছে। এই উদাহরণ গ্রহণ করে বিশ্বের অন্যান্য (মেক্সিকো এবং যুক্তরাজ্যের) অনেক শহরেও পার্কলেট গড়ে উঠছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেও এর ধারাবাহিকতায় ‘দি ইনষ্টিটিউট অব ওয়েলবিয়িং’ নামক একটি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে ইতোমধ্যে বেশ কিছু অস্থায়ী পার্কলেট তৈরি করা হয়েছে। এই সব অস্থায়ী পার্কলেটগুলো তৈরি করা হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (দি পিপলস্ ইউনিভাসির্টি অব বাংলাদেশ, আশা ইউনিভাসির্টি অব বাংলাদেশ এবং স্ট্যামফোর্ড ইউনিভাসির্টি বাংলাদেশ, আলহাজ্ব মুকবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, কাকলি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ) ক্যাম্পাসের সামনে।
সাধারণত রাস্তার পাশে ঘেরা দিয়ে রাস্তা থেকে আলাদা করে পার্কলেট তৈরি করা যায়। যেখানে বসার জন্য চেয়ার, বেঞ্চ বা টুলের ব্যবস্থা থাকে। পার্কলেট এর ধারণা আন্তর্জাতিকভাবে এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, পার্কলেট দিবস পালনের জন্য আলাদা একটি দিন রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় শুক্রবার বিশ্ব পার্কলেট দিবস হিসাবে পরিচিত।
প্রতিটি এলাকাতে পার্কলেট গড়ে তোলা হলে বাসা-বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় শিশুরা বিনোদনের সুযোগ পাবে এবং তাদের মানুষিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। শিশুরা এখানে বসে ছবি আঁকা, খেলাধূলা করার জায়গা পাবে, একে অপরের সাথে সামাজীকিকরনের সুযোগ তৈরি হবে, নতুন প্রজম্মের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ হবে, শক্তিশালী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, ক্লান্ত পথচারীরা বিশ্রামের সুযোগ পাবে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসার প্রসার ঘটবে, স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। পার্কলেট তৈরির মাধ্যমে সকলের জন্য একটি প্রানবন্ত ও নিরাপদ এলাকা তৈরি করা সম্ভব। যাতে সাধারণ মানুষসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষেরা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে। শহুরে সমাজে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সম্পন্ন নাগরিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হলে পার্কলেট এর কোনো বিকল্প নেই।
আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা
আইনজীবি ও কলাম লেখক