গুরুত্বপূর্ণদেশ

ভারতের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ করিডোরপ্রকল্প বাতিলের পথে বাংলাদেশ

ভারতের প্রস্তাবিত ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাতীয় নিরাপত্তা, গ্রিড ঝুঁকি, পরিবেশগত বিপর্যয় ও আর্থিক দায় বিবেচনায় প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। চলতি বছরের মধ্যেই ভারত এই প্রকল্প শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এই মুহূর্তে প্রকল্পটি অনুমোদনের পক্ষপাতী নয়।

প্রস্তাবিত সঞ্চালন লাইনটি ভারতের মেঘালয়ের বোরানগর থেকে বাংলাদেশে পার্বতীপুর হয়ে বিহারের কাটিহার পর্যন্ত যাবে। এর মাধ্যমে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চায়। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্পে অর্থায়নের আশ্বাস দিলেও বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে গ্রিড সংযুক্তি। বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎ গ্রিড ভিন্ন মানের হওয়ায়, একীভূত হলে এক দেশের বিভ্রাটে অন্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন, ভারতে কোনো ‘ব্ল্যাকআউট’ ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়তে পারে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্রকল্পটি চাপ তৈরি করতে পারে। দেশের চলমান ও নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপরীতে বাংলাদেশকে ২.১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। নতুন প্রকল্প হাতে নিলে বৈদেশিক ঋণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে অর্থ ও পরিকল্পনা বিভাগ।

সবচেয়ে গুরুতর শঙ্কা দেখা দিয়েছে পরিবেশগত দিক থেকে। প্রস্তাবিত সঞ্চালন লাইনটি যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ আনবে, তা ব্রহ্মপুত্র নদে নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ কমে গেলে নদীভাঙন, কৃষি বিপর্যয় এবং জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদদের।

অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সমকালকে বলেন, “মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য এত বড় ঝুঁকি নেওয়া অনুচিত। আগের বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো হয়েছে জনস্বার্থ উপেক্ষা করে। নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জনসম্পৃক্ততা জরুরি।”

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিবেশগত প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত হবে। সঞ্চালন লাইন স্থাপনের আগে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।”

বর্তমানে ভারত থেকে বাংলাদেশ ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। এর মধ্যে ১,৫৭০ মেগাওয়াট সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক এবং ১,৪০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করছে আদানি গ্রুপ। সম্প্রতি ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল থেকেও বাংলাদেশে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে।

সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্পটি এখন প্রশ্নের মুখে। অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্প বাতিলের দিকেই এগোচ্ছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *