ট্রাম্পের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ দাবি উড়িয়ে দিল ইরান, হুঁশিয়ারি ‘অপূরণীয় ক্ষতির’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’-এর দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি বলেন, শান্তি বা যুদ্ধ—ইরানের ওপর কোনোটিই চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তবে তার ফল হবে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’।
বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টেলিভিশন ভাষণে খামেনি বলেন, “ইরানি জাতি আত্মসমর্পণ করবে না। আমাদের ইতিহাস এবং মনোবল সম্পর্কে যারা জানে, তারা এমন দাবি করত না। ট্রাম্পের এই আহ্বান বাস্তবায়ন অসম্ভব।”
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, শুক্রবারের ইসরায়েলি বোমা হামলার পর এটিই ছিল খামেনির প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া।
খামেনি আরও বলেন, “আমেরিকানদের জানা উচিত—ইরানে যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে, যার পরিণতি তারা বহন করতে পারবে না।”
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনা
এই সময়েই বিবিসি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মিলে ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছে। সিবিএস নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলার লক্ষ্য হতে পারে ফোর্ডো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা পাহাড়ের প্রায় ৩০০ ফুট নিচে অবস্থিত এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সুরক্ষিত।
যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরে এই আক্রমণের ব্যাপারে পূর্ণ ঐক্যমত্য নেই। হোয়াইট হাউসের ‘সিচুয়েশন রুম’-এ অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, ও জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।
ট্রাম্পের ভাষ্য ও খামেনির প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ বলেন, “আমরা জানি তথাকথিত সর্বোচ্চ নেতা কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি একটি সহজ লক্ষ্য হলেও আমরা এখনই তাঁকে হত্যা করব না।” এরপরেই তিনি দাবি করেন, “আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার” চাই ইরানের কাছ থেকে।
খামেনি এই দাবির প্রতিক্রিয়ায় ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) লেখেন, “মর্যাদাবান হায়দারের নামে, যুদ্ধ শুরু হলো।” তিনি আরও লেখেন, “সন্ত্রাসী জায়নবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর জবাব আসবে—আমরা দয়া দেখাব না।”
ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে
ইসরায়েল জানায়, তারা তেহরানে অস্ত্র গুদাম ও সেন্ট্রিফিউজ স্থাপনাগুলোতে রাতভর হামলা চালিয়েছে। পাল্টা জবাবে ইরানও ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এতে ইসরায়েলে কমপক্ষে ২৪ জন এবং ইরানে ২২৪ জন নিহত হওয়ার দাবি করা হয়েছে। দুই দেশেই আহত হয়েছেন শত শত মানুষ।
এরদোয়ান ও রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেন, “ইরানের আত্মরক্ষা একটি ন্যায্য ও আইনগত অধিকার।” একইসঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে নেতানিয়াহুকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ‘বড় হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেন, “ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দিলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।”
পারমাণবিক উত্তেজনা বাড়ছে
আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য উপযোগী ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়াচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা মূল্যায়নে বলা হয়েছিল, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। তবু ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচিকে আরও জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মিলে সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে ইরান দিয়েছে কড়া হুঁশিয়ারি—এই অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ট্রাম্প ও খামেনির শক্ত অবস্থান, ইসরায়েলের একতরফা হামলা ও তুরস্ক-রাশিয়ার কূটনৈতিক বার্তা সবমিলিয়ে গোটা বিশ্ব এখন নজর রেখেছে পারস্য উপসাগরের দিকে। যুদ্ধের ছায়া ঘন হয়ে আসছে।